সুন্দরবনের টাইগার টিলায়
top of page

সুন্দরবনের টাইগার টিলায়

By Farzana Afroz

 

গতরাতে ডাইনিং টেবিলে সবাই খুব দোটানায় ছিল, সকাল ছয়টায় কি বের হবে? এত সকালে বের হয়ে কি লাভ! শুধু শুধু ঘুমটা নষ্ট হবে, অনেক দূর হাঁটতে হবে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কি সম্ভব!


সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল সকাল ছয়টায় যারা যেতে চায়, তারা যেন ব্রেকফাস্ট রুমে রেডি হয়ে চলে আসে।


আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম যা কিছু হওঁয়ে যাক, এসেছি যখন বের হয়ে দেখবোই। খুব বেশি হলে আয়ানকে একটু কোলে নিয়ে টানতে হবে এটাই তো! কোনো সমস্যা নাই, আমি পারবো, এই সিদ্ধান্তটা আমার পুরো সুন্দরবন ট্রিপকে সার্থক করে দিয়েছে।

যথাসময়ে পুরো প্যাকিং হয়ে ছেলেকে নিয়ে ট্রলারে চেপে কটকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কটকায় পৌঁছেই টুরিস্ট গাইডের সেই একই কথা, তবে এবার যেন সাবধানতার পরিমাণটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তিনি জানালেন, "যেখানে হরিণ সেখানেই বাঘের বসবাস। আজকে আমরা বাঘের টিলায় ঘুরবো।”


কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার প্রথম যেটা মনে হচ্ছিল, আশেপাশে যদি একটা ভালো লাঠি পেতাম এবং সবসময় চোখ কান চারিদিকে খোলা রেখে হাঁটতে হবে, বলা যায় না বিপদ যেকোন সময় হতে পারে। কিছু দূর হাঁটতেই গহীন বন শুরু হলো, এক পাশে দেখলাম হরিণের ঝাঁক কি সুন্দর করে এক সাথে হেঁটে বেড়াচ্ছে! সবাই তখন ডানপাশে হরিণের ছবি তুলতে ব্যস্ত, আর আমি ব্যাস্ত একটা লাঠির জন্য। ভাগ্যক্রমে একটা চিকন ডাল পেয়ে গেলাম। একটু ডানে বামে তাকাতেই হঠাৎ দেখতে পেলাম, কিছু একটা রাজকীয় ভাবে হেঁটে বনের গহীনে প্রবেশ করছে। বুঝতে আর দেরী হলো না, বাঘ মামার দর্শন পেয়ে গিয়েছি এবার আমার হাত পা কাপাকাপি শুরু, পাশে থাকা জিদানকে বললাম, জিদান দেখো এই যে বাঘ চলে গেল ভিতরে। ও শুধু আমাকে বলল আন্টি এটা চিত্রা হরিণ।


কোনভাবেই ওকে বুঝাতে পারলাম না একটা হরিণ একা কখনও বনের গহীনে প্রবেশ করবে না, আর হরিণেরা সবসময় একসাথেই থাকবে।

যাই হোক নিজের মনের ভুল মনে করে ব্যাপারটাকে ভুলে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করলাম।কিন্তু মাথায় তখনও ঘুরপাক খাচ্ছিল, পুরো পিছন থেকে আমি দেখলাম হেঁটে গহীন বনে ঢুকলো। সেকি রাজকীয় হাঁটা! কিছুদূর হাঁটতেই গাইড জানালেন “এখান থেকে বাঘের রাজত্ব শুরু।” এখানে অনেকগুলো টিলা আছে। জোয়ার-ভাটায় যখন পানি উঠে যায়, তারা টিলাতে রোদ পোহান, বিশ্রাম নেন, অনেক সময় খাবার খান, মাঝে মাঝে সেই লেভেলের আড্ডা মেরে থাকেন। আমি তখন পুরাই শিওর, কারণ আমি যে প্রাণীটিকে ভিতরে ঢুকতে দেখেছি, তা এখানেই গিয়েছে। টুরিস্ট গাইড সতর্কতাবাণী আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কেউ গ্যাপ রাখবেন না। শব্দ করবেন না। সবাই একসাথে চলেন।”


কিন্তু সেলফি তুলতে তুলতে আমাদের দলটা তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেল। কিছু মানুষ একেবারে ফরেস্ট অফিসারের সাথে সামনে চলে গেল, মাঝখানে একটা বিশাল গ্যাপ। তারপরেই আমরা কয়েকজন। তারপর আরেকটু গ্যাপ দিয়ে বাকি মানুষেরা ছিলেন।

আমি আর আমার ছেলেটা সামনে, ঠিক পেছনে আমার ছোট বোন, ভাইয়ের দুই মেয়ে এবং বোনের মেয়েটা। আমাদের সামনে ও বিশাল গ্যাপ পিছনেও বিশাল গ্যাপ। নিচে পুরাটা ম্যানগ্রোভ।কোন নির্দিষ্ট রাস্তা নেই, সূর্যের আলো টা তুলনামূলকভাবে খুব কম পৌঁছায় এই জায়গায়।


হঠাৎ করে যেন বাঘের হুংকার কানে বেজে উঠল। সাথে সাথে ছোট বোন বলল, মুক্তা আপ্পি শব্দ পেয়েছো , এটাতো বাঘের হুংকার! ওকে আশ্বস্ত করার কোনো ভাষা নেই

আমার কাছে, শুধু বললাম, ভয় পাস না আমার কাছে লাঠি আছে। ডান বামে দেখে চল।বাঘ আমাদের দেখতে পারে আমরা কিন্তু দেখতে পাই না, খুব সাবধানে পা ফেলে হাঁট, হাত-পা যেন বরফের মত শীতল হয়ে আসছিল, শুধু একটাই ভয়, আমি একেবারে সামনে আমার সাথে আমার ছোট্ট ছেলেটা, আর ঠিক পিছনেই বোনের মেয়েটা , বাচ্চার হাত শক্ত করে ধরলাম, মনে মনে শুধু বলছিলাম আল্লাহ এইটুকু পথ পার করে দাও!



আর একবার যেন হুংকার টা শুনতে পেলাম।মনে হচ্ছিল প্রতিটা হুংকারে বাঘ বুঝাতে চাচ্ছিল, এটা তারই রাজ্য। এই রাজ্যের সেই একমাত্র রাজা।

পায়ের গতিবিধি বাড়িয়ে একটু এগুতেই দেখলাম, একটা টিলার উপর হরিণের হাড্ডি!

মনে হচ্ছিল বাঘ মামারা খুব আয়েশ করে হরিণটাকে খেয়েছে!

আর একটু এগোতেই আমাদের শওকত ভাই থেমে থেমে সবাইকে বাঘের পায়ের চিহ্ন দেখাচ্ছেন,ঠিক মনে হচ্ছে এইমাত্র কাদামাটি পার হলো । সামনে গিয়ে ফরেস্ট অফিসার এবং সবাইকে একসাথে পেয়ে একটু মনের মধ্যে শান্তি কাজ করছিল। কিন্তু তখনও বিপদ কমে যায়নি। বাঁশির আওয়াজ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আরও সতর্ক হয়ে হাঁটতে হবে। পুরোটা পথ শুধু মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ঝোপঝাড় থেকে বের হয়ে আসবে! অবশেষে হাঁটতে হাঁটতে কটকা বিচের পারে চলে আসলাম।


সামনেই ফরেস্ট বিল্ডিং গুলোগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এ দফায় বেঁচে গেলাম।


পুরোটা পথ যেন একটা লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা ছিল। ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না অনুভূতিটা কেমন ছিল। তবে সুন্দরবনের সার্থকতা মনে হয় এই পথের মধ্যেই।


শুনেছি সুন্দরবনে নাকি বাঘ দেখা যায় না, এটাও সত্যি শোনা কথায় কান দিতে হয় না ।

ট্রলারে চেপে শীপে পৌঁছাতেই অ্যানাউন্সমেন্ট শুরু, দুপুরের লাঞ্চ শেষ করেই বিকালে সূর্যাস্ত দেখব দুবলারচর সৈকতে।

bottom of page